রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মানুষ ওয়াদা করে ওয়াদাভঙ্গের জন্য, তবে আমরা আশা করব আমাদের প্রবীণ অর্থমন্ত্রী গত ১১ জুন বাজেট উপস্থাপনের মাধ্যমে জাতির জন্য যে ওয়াদা করেছেন তা রাখার জন্য করেছেন। পালনের জন্য করেছেন। বলা ভাল বাজেটে তিনি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আমরা ভালভাবেই জানি, বাজেটে শুধু এক বছরের বরাদ্দ থাকে। কিন্তু শঙ্খের মাঝে যে সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়। বাজেটের মধ্যে অর্থনীতি পরিচালনার মূল সুরটি ধ্বনিত হয়। তাই আমরা কান পেতে মন দিয়ে শুনি বাজেটে কি আছে। এবার বাজেটে আশা যাক। অর্থমন্ত্রী যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন তার অংক হল ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয় ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এখানে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। সরকার ও ব্যক্তি উদ্যোক্তার যৌথ উদ্যোগে অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। কথা দেয়া হয়েছে কর্মরত শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার আগে কোন লোকসানী কারখানা বিরাষ্ট্রীকরণ করা হবে না। নতুন করে যুক্ত হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার পর কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ছাত্রদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের কথা। আছে নারী সংবেদনশীল বাজেটের খবর। সর্বমোট ১০৮ পৃষ্ঠার একটি বর্ণনামূলক বাজেট।বাজেটের পর অর্থনীতির জগতে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে বাজেটের বিশালত্ব, বাস্তবায়ন সংশয়, কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব, সরকার ও ব্যক্তি উদ্যোক্তার যৌথ বিনিয়োগের নেতিবাচক দিকসমূহ। গুরুত্ব পাচ্ছে না জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট উপস্থাপনের খবর এবং দরিদ্র এলাকার ছাত্রদের স্কুলে খাবার দেওয়ার মত প্রস্তাব। দৃশ্যমান হচ্ছে রপ্তানি শিল্পের সুবিধা না পাওয়ার ক্ষোভ, কর আরোপ করা নিউজ প্রিন্ট ব্যবহারকারীদের ধমক।
অভিযোগ- বাজেটের অংক অনেক বড়, এটির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাজেট কি আদতেই বড়? একেবারেই কি অবাস্তবায়ন যোগ্য? প্রস্তাবিত বাজেট ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এটি আমাদের জিডিপি’র ১৬.৫ শতাংশ। গতবারের বাজেট ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে জিডিপি’র ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাজেট হয়। বাজেট বড় করার প্রতি অর্থনীতিবিদদের অনীহার প্রধান কারণ, অর্থায়নসূত্রের অনিশ্চয়তা। এছাড়া অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কর্মসূচি কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই। ২০ হাজার কোটি টাকার অধিক উন্নয়ন কর্মসূচি এ পর্যন্ত কখনও বাস্তবায়িত হয় নি।বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সূত্র হল বৈদেশিক সাহায্য, রাজস্ব আয় ও ব্যাংক ঋণ। গুরুগৃহ এখন মন্দায় আক্রান্ত। অতএব বৈদেশিক সাহায্যের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন শর্ত দিয়ে ঋণ নেয়া হবে না। দ্বিতীয় সূত্র রাজস্ব আয়। এটি খুব নির্ভরযোগ্য নয়। অন্যটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। ব্যাংক থেকে সরকার টাকা ধার নিলে বিনিয়োগের সম্ভাবনা কমে যাবে। যা আমরা কোন ভাবেই চাইতে পারি না। অতএব সম্ভাবনার যদি কিছু থাকে তাহলো রাজস্ব আয় বাড়ানো। রাজস্ব আয়ের প্রধান সূত্র আয়কর। দেশে টি.আই. এন. নম্বর প্রাপ্তদের সংখ্যা ২২ লাখ। কিন্তু কর দিচ্ছেন মাত্র ৭ লাখ। আমরা আমাদের কর প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, কর দাতা কর দিয়ে বিনিময়ে কি পাচ্ছেন? এটি একটি অনুসঙ্গ হতে পারে। তবে আয়কর কর্মকর্তাদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা হল ‘বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা’ অতএব যে কোন ভাবে যতক্ষণ পারা যায় এদের থেকে দূরত্ব রেখে চলা। কর কর্মকর্তাগণ অনেক সময় জনগণকে অহেতুক ঝামেলায় ফেলে মধ্যস্বত্ব ভোগ করতে চায়। যা মানুষ কোন মতেই পছন্দ করে না। এসব আমরা কমবেশি সবাই জানি। আমাদের অবশ্যই এ ধারা পরিবর্তন করতে হবে।বাজেটের আর একটি প্রস্তাব, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দান। আমাদের দেশে প্রতিবছর এটি সমালোচিত হয়। সরকারি দল প্রস্তাব করে বিরোধীদল বিরোধিতা করে। এটা ঠিক, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এটি করেছে। কিন' কাজটি অনৈতিক। এবং ভুল ইঙ্গিত করে। এবার টাকা সাদা করার সময় কাল তিন বছর। কালো টাকা দুইভাবে চিহ্নিত হতে পারে। প্রথমত কেউ যদি সৎ উপায়ে উপার্জন করেও কোন কারণে কর ফাঁকি দেয়। দ্বিতীয়ত অনৈতিক উপায়ে অর্জিত টাকা। এ টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার অর্থ নীতিহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। কেন আমরা কাজটি করছি আমাদের আয়কর বাড়ানোর জন্য, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কিন্তু আমরা কেন মনে করছি এ সব টাকা আগেকার দিনের মত বালিশের ভিতর বা মাটির নিচে থেকে অচল হয়ে আছে। এ টাকা অবশ্যই বাজারে চলছে। যে কারণে বারবার ঘোষণা দিয়েও আমরা যথেষ্ট পরিমাণ টাকা পেয়েছি এ জাতীয় উদাহরণ আমাদের নেই। অন্যদিকে যারা এখন নিয়মিত আয়কর দিচ্ছেন তারা কর দিচ্ছেন শতকরা ২৫ ভাগ হারে। আর যারা অনৈতিক উপায়ে অর্জন করে এখন কর দিবেন তারা দিবেন শতকরা ১০ ভাগ হারে। এতে আমরা অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি এবং অন্যদেরও অনৈতিক হতে বলছি। যারা এখন নীতিগত পথে উপার্জন করছেন তারা আগামী ২ বছর কর না দিয়ে তৃতীয় বছরে শতকরা ১০ ভাগ হারে কর দিতে পারবেন। এবার তিন বছরের সময়কালের কথা বলা হয়েছে। তাহলে সাধারণ করের ২৫% হারের চেয়ে কালো টাকার আয়কর হার কম। আমরা আমাদের সন্তানদের পাঠ্যপুস্তকে নীতির কথা লিখছি। আর ওদের সামনে এসব করছি, ওরা বই আর বাস্তবের মধ্যে কোনটা বিশ্বাস করবে? সর্বোপরি মহাজোটের বড় শরিক আওয়ামী লীগ ইশতেহারে দুর্নীতি করবে না বলে সাফ ওয়াদা দিয়েছে। তাদের ওয়াদার কি হবে?
আমাদের অতীত ইতিহাস- বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘাটতি। কারণ অধিকাংশ মন্ত্রণালয় তাদের নির্ধারিত প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে পারে না। আমাদের প্রকল্পের টাকা ছাড়ের পদ্ধতি অত্যন্ত প্রলম্বিত, কখনও কখনও প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর পর্যন্ত গড়ায়। দ্বিতীয়ত এর মধ্যে এমন সব জটিলতা রয়েছে যাতে যে কোন কর্মকর্তা অন্যায় না করেও দোষী হতে পারেন। ফলে প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ আদিষ্ট হয়ে অথবা নির্দেশিত হয়ে কাজ করতে চান। তারা আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে চান না। পরবর্তীতে তার বিরোধী দল ক্ষমতায় আসলে তার রাজনৈতিক বিপদ হতে পারে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে এসব সংস্কৃতি পরিবর্তনে অগ্রগামী হতে হবে। তবে ১৯৯৮ এ বন্যার সময়কালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একদিনের মধ্যেও প্রকল্পের অর্থ ছাড় হয়েছে এধরনের উদাহরণও রয়েছে।
বিষয় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) দেশের অবকাঠামে গড়ে তোলা। এটি শুনতে আপাতত মধুর হলেও খুব স্বচ্ছ কিছু নয়। অবকাঠামে গঠন করা আমাদের প্রয়োজন, অতীতেও এ ধরনের হয়েছে। কিন্তু সাবধানতার প্রয়োজন রয়েছে। যে প্রকল্পগুলো বড়, যেখানে বিদেশি লগ্নীকারীদের লাগতে পারে, তারা লাভের দিকটিই দেখবে দেশের দিক দেখবে না। এখন আমাদের লগ্লিকারী বন্ধুরা এমনটিই চান। আমাদের হয়ত প্রয়োজন উত্তরবঙ্গে রেলপথ করা, তারা বলবেন দক্ষিণ বঙ্গের কথা। যেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা এখনই ভাল। সুতরাং দেশের সর্বোচ্চ ভালটির জন্য অর্থলগ্নীকারীর অভাব হতে পারে। এছাড়া যদি সড়ক শিক্ষাঙ্গন ইত্যাদির কাজ করা হয় তাতে সরকারের একচ্ছত্র কর্র্তৃত্ব নাও থাকতে পারে। বিষয়গুলো বিবেচনার প্রয়োজন রাখে।জেন্ডার ভিত্তিক বাজেটের প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে নারীর হিস্যা নিশ্চিত করার জন্য প্রথমবারের মত নারী উন্নয়নে বরাদ্দের পরিমাণ নিয়ে চার মন্ত্রণালয়ের (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণত, সমাজকল্যাণ এবং খাদ্য ও দুর্র্যোগ ব্যবস্থাপনা) পৃথক প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথাও বলেছেন অর্থমন্ত্রী। সর্বোপরি ১৯৯৭ সালে প্রণীত নারী নীতি বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। ইতোপূর্বে আমরা বহুবার জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দটি বাজেটে দেখেছি, কিন' বরাদ্দ পাই নি। এবার এ বাজেটে বাস্তবতার অবকাশ আছে। নারীনীতির বাস্তবায়নের বিষয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে বাজেট সরকারের একটি দলিল। এখানে এর উল্লেখ আমাদের আশাবাদী করেছে।বাজেটে অতি দরিদ্রপীড়িত এলাকার স্কুলে শিক্ষার্থীদের খাবার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখবর। এছাড়াও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতি ও বিদ্যুতের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাজেটে, যা সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা পালনে নিষ্ঠার ধারণা দেয়।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ ইডেন মহিলা কলেজ ঢাকা।
সুত্রঃ দৈনিক আজাদী
========================================
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দিয়ে খুবি অন্যায় কাজ করেছে সরকার। আগামীতে সবাই এইভাবে সুযোগ নিবে। আবারো আমাদের দেশ দুর্নিতীর দিক দিয়ে এক নম্বরে চলে এল। আওয়ামিলীগ ওয়াদা রাখতে পারলনা...
No comments:
Post a Comment
নিজের মতামত প্রকাশ করলে ভাল লাগবে। ধন্যবাদ!