Tuesday, November 16, 2010

বিবর্তন

লাল, নীল, সবুজ মালায় সেজে গরু আসত আমাদের চট্টগ্রামের বাড়িতে। অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম, এই বছরের গরু দেখতে কেমন হবে, কি রঙের হবে? সাদা, কালো, বাদামী নাকি অস্ট্রেলিয়ান? এই নিয়ে তর্ক চলত চাচাত ভাই, বোনদের মধ্যে। বাবারা সাত ভাই। সাত পরিবারের বসবাস একটি পাঁচতলা বাড়িতে। সেই ভোরে উঠে উনারা হাঁটে যেত গরু কেনার জন্য। পাঁচতলা ছাদে দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করতাম। যখন দেখতে পেতাম তিনটে গরু নিয়ে আসছে, কার আগে কে নিচে নেমে আম পাতা খাওয়াবে তার প্রতিযোগিতা লাগত। প্রতিদিন গরুর মুখ খানা না দেখলে যেন দিন ভালো যাবেনা তাই ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই গরু দেখতে যেতাম। তিন চার দিন সে কি সমাদর, ঘাস খাওয়ানো, গোসল করানো, গোবর পরিস্কার করা, রাখালের মত মাঠে নিয়ে সঙ্গ দেওয়া, বাকি গরুদের সাথে তুলনা করা আরো কত কি। একটা জিনিষ দেখে অবাক হতাম কোরবানির আগের দিন গরুর চোখে জল। ছোটবেলায় ভাবতাম আসলে কি গরু কান্না করে?

সারা বছর আলাদা রান্না হলেও ঈদ আসলে এক হয়ে যেত সাতটি পরিবার। সাত পরিবারের সদস্য এক হলে আড্ডা আর আড্ডা। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মসলা ইত্যাদি তৈরি করার দায়িত্ব থাকত বাবুর্চিদের। সদস্য বেশি বলে বাবুর্চি দিয়ে রান্না করানো হত। মায়েরা সকালের নাস্তার জন্য সেমাই, চুটকি এবং চটপটির ব্যবস্থা করতেন। আমাদের কাজ ছিল মা-দের সাহায্য করা, টিভি দেখা আর খাওয়া। মাংস কসাইরা কেটে দিত, তবে ছোট টুকরো করে নিত মায়েরা। বিশাল আকারের কয়েকটা পাটি বিছিয়ে অপেক্ষা করত দাদী, মা, ছয় চাচী আর সহ কর্মীরা। চোখে ছানি পড়ায় দাদী দেখতে পেতেন না। তবে নিজের কাজ সব নিজেই করতেন। মাংস কাটতেও কোন ভুল হতনা। দাদীর ইচ্ছা শক্তি দেখে অবাক হতাম। মাংস টুকরো করতে করতে নানা রকমের গল্পে আসরটা হয়ে উঠত জমজমাট। অধীর আগ্রহে নতুন জামা পড়ে অপেক্ষা করতাম সিন্নির মাংসের (প্রথম যে মাংস রান্না করা হবে তাতে হাড্ডি, মাংস, কলিজা ইত্যাদি থাকতে হবে) জন্য। সিন্নির মাংস হলে সব চাচাত ভাই, বোনেরা মিলে বাকরখানি, পরটা, চালের রুটি দিয়ে মাংস খাব। আহ! বাকরখানি খুব খেতে ইচ্ছে করে। কবে আবার খেতে পারব কোরবানির মাংস দিয়ে বাকরখানি। বাবুর্চিরা ইট পাথরের চুলায় কাঠ জ্বালীয়ে বিশাল আকারের ডেকচিতে সিন্নির মাংস রান্না করত। সেই মাংসের স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে। সবাই মিলে মাংস বিলাতে যেতাম গরীবদের এবং পাড়া পড়শিদের। তারপর থাকত কাবাব, আমার মা খুব মজার কাবাব বানাতেন। সিন্নির মাংস খাওয়া শেষ হলে কখন কাবাব খাব তা নিয়ে আম্মাকে সবাই তাড়া দিত। অবশেষে রাতে হত বিরানীর পালা, তখন দুই ফুফির পরিবার এসে যোগ দিত। ঈদের যে কত আনন্দ, কত রঙ তা আজকাল আর টের পাইনা। পনের বছর বয়সে দেশ ছেড়েছি, মনে হয় যেন সেদিনের কথা। তবে আগের মত ঈদ কি হয়? সময়ে কেমন যেন সব কিছু পাল্টে যায়।


ফ্লোরিডায় আসার পড় মা, বাবার কাছে ছিলাম বেশ আনন্দে। আম্মু এবং আব্বু খুব চেষ্টা করত দেশের স্বাদ দিতে। সারাদিন, কলেজ করে, কাজ করে এসে বাসায় দেখতাম ঈদের আয়োজন। তখন ফুরফুরে হয়ে যেত মন। ক্লান্তি ক্ষমা করে দিত আমায়। শনি অথবা রবি বার না হলে, ঈদ শুরু হত সন্ধ্যা বেলা সবাই কাজ থেকে ফেরার পর। ফ্লোরিডায় প্রায় দু’ঘন্টা ড্রাইভ করে যেতে হয় কোরবানী করতে। লম্বা লাইন ধরতে হয় ফার্মে জবাই করা মাংস আনার জন্য। আমাদের বাড়ির পেছনের উঠোনে আব্বু খুব কৌশলে আস্ত মাংস দড়ি দিয়ে ঝুলাত। আম্মু, আমি, ভাবি বসতাম বটি নিয়ে। আমরা মাংস কাটতাম আব্বু আর ভাইয়া হাড্ডি। আর আন্টি বানাত চালের রুটি। বেশ জমজমাট হত। রাতে সিন্নির মাংস খুব মজা করে খেতাম পরোটা দিয়ে অথবা চালের রুটি। বাকরখানি ছাড়া। ঈদ সীমাবদ্ধ ছিল অনেকটা নিজ বাড়ির ভেতরেই।


বিয়ের পড় এখন আমি কানাডায়। ঈদের দিন, অফিসের কাঁচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সাধা ধব ধবে তুষারের দিকে তাকিয়ে ভাবি সময়ের সাথে সাথে মানুষকে কিভাবে বদলে যেতে হয়। এখানেও ঈদ পালন করতে চেষ্টা করি তবে, বাংলাদেশী গ্রোসারীতে ওরডার দেওয়া কোরবানির মাংস দিয়ে। এখন মনে হয় যদি ফ্লোরিডার ঈদের মজাটা ফিরে পেতাম! বাংলাদেশের সেই ঈদ যেন ধূসর স্বপ্ন।



ঈদ মোবারক!

Wednesday, November 10, 2010

ঈদ বৃষ্টি

২১ সেপ্টেমম্বার ২০০৯, ঈদ শুরু হয় ঝুমবৃষ্টিতে। ভোর সাতটায় রাহাতের সাথে বেড় হয়েছিলাম রিক্সায় করে পরোটা আনার জন্য। বৃষ্টি পড়ছে জেনে রাহাত ছাতা নিয়ে নিয়েছিল। বে-রসিক! ও চায়না আমরা কেউ অসুস্থ হয়ে পরি। কে চায়? কিন্তু বৃষ্টি পড়লে আমার কি করার আছে? আরে বাবা রিক্সায় উঠলাম, বৃষ্টি পড়ছে, ফাঁকা রাস্তা, আমি তুমি, এর চেয়ে পারফেক্ট আর কি হতে পারে? তার মাঝে ছাতা কেন? ছাতাটা আমার হাতে নিয়ে ফেলি। রিক্সার হুড ফেলে বসি। রিক্সা থামে একটি চায়ের দোকানের পাশে। রাহাত নেমে পড়ে, আমি রিক্সায় বসে বৃষ্টি উপভোগ করছিলাম। রাহাত নেমে পড়ার সাথে সাথে বৃষ্টি বেড়ে গেল। ইস কি মজা! ভেতর থেকে রাহাত বার বার বলছিল মিনা হুড তুলে দাও, মিনা অসুস্থ হয়ে যাবা, মিনা ছাতা ধর, আমি শুধু হাসি। যখন রাহাত উঠে এল রিক্সায়, কি অদ্ভুত! বৃষ্টি কমে যায়। তাই বাসা ফেরার পথে হুড এবং ছাতা লাগেনি। আমাকে ওর পুরোনো পরিচিত অলি গলি দেখিয়ে নিয়ে আসে।

বাসায় ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়, আপুকে অনেক বার অনুরোধ করি আমাকে ছাদে নেয়ার জন্য। একা যেতে চাইছিলাম না। শুধু বলে তালা মারা ছাদে। আমার শাশুরি আপুকে, রাহাতকে বলে আমাকে নিয়ে যেতে। আমি ভিজতে চাই কতদিন ছাদে উঠে ভিজিনা। কেউ নিতে চায়না সবাই ব্যস্ত। বৃষ্টি আমায় ডাকছে, কিন্তু আমার ডাকে কেউ সারা দিচ্ছিলনা, তাই একলা পথ বেছে নিয়েছিলাম। "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে…" দৌড় দিয়ে দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকি জানিনা কত উপরে ছাদ। এলিভেটর ছিল, যদি কারেন্ট চলে যাই? আমি ভুলেও এলিভেটরে উঠিনা। উঠতে উঠতে চিন্তা করতে থাকি ছাদ বন্ধ থাকে যদি? তখন? কি আর করব নেমে আসব নিরাস হয়ে তারপরও নিজেকে বুঝ দিতে পারব চেষ্টা করেছিলাম। এতক্ষনে সাত ফ্লোরে উঠলাম ২ থেকে ৭? না স্পীড বারাতে হবে। আর কত বাকি কে জানে। জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি কমে আসছে। এদিকে রাহাত পেছন নিয়েছে আমার। আমি হেসে ফেলি। আলো দেখা যাচ্ছিল, আমার খুশি দেখে কে? নয় পেরিয়ে দশে ছাদ। বাহ! সব চেয়ে বড় কথা হল ছাদ খোলা। সার্থক! আমি পৌঁছানোর পড় ঝুমবৃষ্টি আমায় বরণ করে নিল। মনে হচ্ছিল এতক্ষন আমারি অপেক্ষায় ছিল। রাহাত তখন রেডি হয়ে যায় নামাজ পড়ার জন্য। তাই বৃষ্টির সঙ্গী হতে পারেনি। তবে আমি আমার সঙ্গীনি ছিলাম। মন্দ কি? তারপরও খুশি ও এসেছে। "ও মোর রমযানের ঐ রোযার শেষে এল বৃষ্টির ঈদ" কিচ্ছুক্ষণ আগেও কল্পনা করিনি বৃষ্টির পানিতে আমার ঈদের স্নান হবে। মা’মনি জিজ্ঞেস করে “কি মা প্রাণ ভরে বৃষ্টিতে ভেজা হয়েছে তো?” দুলা জিজ্ঞেস করে "কি শান্তি?" আপু "কি কেমন লাগল?" খুব খুব খুব ভালো, শান্তি, দারুন ভাবে আমার ঈদ শুরু…